আকিদা কাকে বলে, আকিদার অর্থ কি, মুসলমানদের কতিপয় আকীদা । Islamic Media Blog
![]() |
আকিদা কাকে বলে, আকিদার অর্থ কি, মুসলমানদের কতিপয় আকীদা । |
মুসলমানদের কতিপয় আকীদা
মে'রাজ সম্বন্ধে আকীদা :
আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)কে আলাহ তাআলা একদা রাত্রে জাগরিত অবস্থায় সশরীরে মক্কা শরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত নিয়ে যান। সেখান থেকে সাত আসমানের উপর এবং সেখান থেকেও আরও উপরে যতদূর আল্লাহর ইচ্ছা নিয়ে যান। সেখানে আল্লাহর সাথে রাসূল (সঃ) কথাবার্তা বলেন । তখনই পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বিধান দেয়া হয় এবং সেই রাতেই রাসূল (সঃ) আবার দুনিয়াতে প্রত্যাবর্তন করেন। একে মে'রাজ বলে।
আরশ কুরছী সম্বন্ধে আকীদা :
‘আরশ' অর্থ সিংহাসন, আর 'কুরছী' অর্থ চেয়ার বা আসন। আল্লাহ যেমন, তার আরশ এবং কুরছীও তেমনই শানের হয়ে থাকবে। সপ্তম আসমানের উপর আরশ ও কুরছী অবস্থিত। হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী আরশ কুরছী এত বিশাল যে, তা সমগ্র আকাশ ও জমীনকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, আল্লাহ পাক কোন মাখলুকের ন্যায় উঠা বসা করেন না এবং তিনি কোন নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ নন। মাখলুকের কোন কার্যকলাপ ও আচার-আচরণের সাথে আল্লাহর কোন কার্যকলাপ ও আচার-আচরণের তুলনা হয় না । তারপরও তার আরশ কুরছী থাকার কি অর্থ, তা অনুধাবন করা মানব জ্ঞানের উর্ধ্বে। আমাদেরকে শুধু আরশ কুরছী সম্বন্ধে আকীদা বিশ্বাস রাখতে হবে।
আল্লাহর দীদার সম্বন্ধে আকীদা :
আল্লাহর দীদার বা আল্লাহকে দেখা সম্বন্ধে ইসলামের আকীদা হল দুনিয়ায় থেকে জাগ্রত অবস্থায় এই চর্ম চক্ষুর দ্বারা কেউ আল্লাহকে দেখতে পারেনি এবং পারবেনা। তবে বেহেশতবাসীগণ বেহেশতে গিয়ে আল্লাহর দীদার (দর্শন) লাভ করবেন। বেহেশতের অন্যান্য নিয়ামতের তুলনায় এই নেয়ামত (আল্লাহর দীদার) সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট ও উপাদেয় মনে হবে। উল্লেখ্য যে, স্বপ্নে আল্লাহকে দেখা যায় তবে সেটাকে দুনিয়ার চর্ম চক্ষু দ্বারা দেখা বলা হয় না।
কিয়ামতের আলামত সম্বন্ধে আকীদা :
হাদীছে কিয়ামতের বহু ছোট ছোট আলামত বর্ণিত হয়েছে যা দেখে বোঝা যাবে যে, কিয়ামত তথা দুনিয়ার ধ্বংস হওয়ার সময় নিকটবর্তী হয়ে গেছে। এই সব আলামতের মধ্যে রয়েছে যেমনঃ লোকেরা ওয়াক্ফ ইত্যাদি খোদায়ী মালকে নিজের মালের মত মনে করে ভোগ করতে থাকবে, যাকাত দেয়াকে দণ্ড স্বরূপ মনে করবে, আমানতের মালকে নিজের মাল মনে করে তাতে হস্তক্ষেপ করবে, পুরুষ স্ত্রীর তাবেদারী করবে, মায়ের নাফরমানী করবে, পিতাকে পর মনে করবে, বন্ধু-বান্ধবকে আপন মনে করবে, খারাপ ও বদ লোকেরা রাজত্ব ও সরদারী করবে, অযোগ্য লোকেরা বিভিন্ন কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে, লোকেরা জুলুমের ভয়ে জালেমের তাযীম সম্মান করবে, নাচ-গান ও বাদ্য-বাজনার প্রচলন খুব বেশী হবে ইত্যাদি। এগুলোকে বলা হয় কিয়ামতের আলামতে ছুগরা বা কিয়ামতের ছোট ছোট আলামত।
কুরআন ও হাদীছে কিয়ামতের কিছু বড় বড় আলামত বর্ণিত হয়েছে, যেগুলোকে আলামতে কুবরা' বা বড় বড় আলামত বলা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে হযরত মাহদীর আবির্ভাব, দাজ্জালের আবির্ভাব, আকাশ থেকে হযরত ঈসা (আঃ)-এর দুনিয়াতে অবতরণ, ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাব, দাব্বাতুল আরদ-এর বহিঃপ্রকাশ, পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় ইত্যাদি। হযরত মাহদীর আবির্ভাবের পর থেকে কিয়ামতের বড় বড় আলামত জাহির হওয়া শুরু হবে।
হযরত মাহদী (আঃ) সম্বন্ধে আকীদা :
কিয়ামতের ছোট ছোট আলামত প্রকাশিত হওয়ার পর একটা সময় এমন আসবে, যখন কাফেরদের প্রভাব খুব বেশী হবে, চতুর্দিকে নাছারাদের রাজত্ব কায়েম হবে, খায়বারের নিকট পর্যন্ত নাছারাদের আমলদারী হবে। এমন সময়
মুসলমানগণ তাদের বাদশাহ বানানোর জন্য হযরত মাহদীকে তালাশ করবেন এবং এক পর্যায়ে কিছু সংখ্যক নেক লোক মক্কায় বায়তুল্লাহ শরীফে তওয়াফরত অবস্থায় হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহীমের মাঝখানে তাকে চিনতে পারবেন এবং তাঁর হাতে বায়আত করে তাঁকে খলীফা নিযুক্ত করবেন। এ সময় তাঁর বয়স হবে ৪০ বৎসর। ঐ সময় একটি গায়েবী আওয়াজ আসবে যে, “ইনিই আল্লাহর খলীফা-মাহদী।"
হযরত মাহদীর নাম হবে মুহাম্মাদ। তাঁর পিতার নাম হবে আবদুল্লাহ। তিনি ফাতেমা (রাঃ)-এর বংশোদ্ভূত অর্থাৎ সাইয়্যেদ বংশীয় হবেন । মদীনা তাঁর জন্ম স্থান হবে। তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস হিজরত করবেন। তার দৈহিক গঠন ও আখলাক চরিত্র রাসূল (সঃ)-এর অনুরূপ হবে। তিনি নবী হবেন না-তার উপর ওহীও নাযেল হবে না। তিনি মুসলমানদের খলীফা হবেন এবং আধিপত্য বিস্তারকারী নাছারাদের বিরুদ্ধে জেহাদ পরিচালনা করবেন এবং তাদের দখল থেকে শাম, কনস্ট্যান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) প্রভৃতি অঞ্চল জয় করবেন। তার আমলে দাজ্জালের আবির্ভাব হবে এবং তার আমলেই হযরত ঈসা (আঃ) অবতরণ করবেন। ঈসা (আঃ)-এর আগমনের কিছুকাল পর তিনি ইন্তেকাল করবেন।
দাজ্জাল সম্বন্ধে আকীদা:
দাজ্জাল শব্দের অর্থ প্রতারক, ধোকাবাজ। আল্লাহ তাআলা শেষ যমানায় লোকদের ঈমান পরীক্ষা করার জন্য একজন লোককে প্রচুর ক্ষমতা প্রদান করবেন । তার এক চোখ কানা আর এক চোখ টেরা থাকবে, চুল কোঁকড়া ও লাল বর্ণের হবে, সে খাটো দেহের অধিকারী হবে। তার কপালে লেখা থাকবে- কাফের, সকল মু'মিনই সে লেখা পড়তে পারবে। ইরাক ও শাম দেশের মাঝখানে তার অভুত্থান হবে। সে ইয়াহুদী বংশোদ্ভূত হবে। প্রথমে সে নবুয়তের দাবী করবে। তারপর ইস্ফাহানে যাবে, সেখানে ৭০ হাজার ইয়াহুদী তার অনুগামী হবে, তখন সে খোদায়ী দাবী করবে। লোকেরা চাইলে সে বৃষ্টি বর্ষণ করে দেখাবে, মৃত্যুকে পর্যন্ত জীবিত করে দেখাবে, কৃত্রিম বেহেশত দোযখ তার সঙ্গে থাকবে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার বেহেশত হবে দোযখ আর তার দোযখ হবে বেহেশত। সে আরও অনেক অলৌকিক কাণ্ড দেখাতে পারবে, যা দেখে কাঁচা ঈমানের লোকেরা তার দলভুক্ত হয়ে জাহান্নামী হয়ে যাবে। এক ভীষণ ফেত্না ও এক ভীষণ পরীক্ষা হবে সেটা। দাজ্জাল একটা গাধার উপর সওয়ার হয়ে ঝড়ের বেগে সমগ্র ভূখণ্ডে বিচরণ করবে এবং মক্কা, মদীনা ও বায়তুল মুকাদ্দাস ব্যতীত (এসব এলাকায় সে প্রবেশ করতে পারবেনা- ফেরেশতাগণ এসব এলাকার পাহারায় থাকবেন ।) সব স্থানে ফেৎনা বিস্তার করবে । হযরত মাহদীর সময় তার আবির্ভাব হবে। সে সময় হযরত ঈসা (আঃ) আকাশ থেকে অবতরণ করবেন এবং তারই হাতে দাজ্জাল নিহত হবে। অভুত্থানের পর দাজ্জাল সর্বমোট ৪০ দিন দুনিয়াতে থাকবে। দাজ্জালের ফেৎনা থেকে বাঁচার জন্য হাদীসে নিম্নোক্ত দুআ শিক্ষা দেয়া হয়েছে - আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিং ফিৎনাতিল মাসিয়ি-হিদ দাজ্জাল।
অর্থঃ হে আল্লাহ, আমি তোমার নিকট দাজ্জালের ফেত্না থেকে পানাহ চাই ।
হযরত ঈসা (আঃ) এর পৃথিবীতে অবতরণ সম্বন্ধে আকীদা :
দাজ্জাল ও তার বাহিনী বায়তুল মুক্বাদ্দাসের চুতর্দিকে ঘিরে ফেলবে এবং মুসলমানগণ আবদ্ধ হয়ে পড়বে। ইত্যবসরে একদিন ফজরের নামাযের একামত হওয়ার পর হযরত ঈসা (আঃ) আকাশ থেকে ফেরেশতাদের উপর ভর করে অবতরণ করবেন। বায়তুল মুকাদ্দাসের পূর্ব দিকের মিনারার নিকট তিনি অবতরণ করবেন এবং হযরত মাহদী উক্ত নামাযের ইমামতি করবেন। নামাযের পর হযরত ঈসা (আঃ) হাতে ছোট একটা বর্শা নিয়ে বের হবেন। তাকে দেখেই দাজ্জাল পলায়ন করতে আরম্ভ করবে। হযরত ঈসা (আঃ) তার পশ্চাদ্ধাবন করবেন এবং “বাবে লুদ” নামক স্থানে গিয়ে তাকে নাগালে পেয়ে বর্শার আঘাতে বধ করবেন।
মুসলমানদের আকীদা অনুযায়ী হযরত ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ তা'আলা সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন, তিনি স্বাভাবিক মৃত্যু বরণও করেননি কি ইয়াহুদীরা তাকে শূলীতে চড়িয়ে হত্যাও করতে পারেনি। তিনি আকাশে জীবিত আছেন। তিনি উপরোক্ত বর্ণনা অনুযায়ী দাজ্জালের আবির্ভাবের পর দুনিয়াতে আগমন করবেন এবং ৪০ বৎসর কাল রাজত্ব পরিচালনা করার পর ইন্তেকাল করবেন। তাকে আমাদের নবী (সঃ)-এর রওযা শরীফের মধ্যে নবী (সঃ) এর পার্শ্বেই দাফন করা হবে। হযরত ঈসা (আঃ) নবী হিসেবে আগমন করবেননা বরং তিনি আমাদের নবী (সঃ)-এর উম্মত হিসেবে আগমন করবেন এবং এই শরীয়ত অনুযায়ীই তিনি জীবন যাপন ও খেলাফত পরিচালনা করবেন।
ইয়াজুজ মাজুজ সম্বন্ধে আকীদা :
দাজ্জালের ফেতনা ও তার মৃত্যুর পর আসবে ইয়াজুজ ও মাজুজের ফেতনা । ইয়াজুজ মাজুজ অত্যন্ত অত্যাচারী সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের সংখ্যা অনেক বেশী হবে। তারা দ্রুত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং ভীষণ উৎপাত শুরু করবে, হত্যা এবং লুটতরাজ চালাতে থাকবে।
তারা বর্তমানে কোন দশের কোথায় কিভাবে অবস্থিত, কি তাদের বর্তমান পরিচয়-তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।(এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহীগণ মাওলানা হেফজুর রহমান রচিত কাছাছুল কোরআন পাঠ করতে পারেন) তখন হযরত ঈসা (আঃ) ও তাঁর সঙ্গীরা আল্লাহর হুকুমে তুর পবর্তে আশ্রয় নিবেন। অন্য মুসলমানরা নিজ নিজ দুর্গে ও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিবে । হযরত ঈসা (আঃ) ও মুসলমানরা কষ্ট লাঘবের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করবেন। আল্লাহ তা'আলা মহামারীর আকারে রোগ ব্যাধি প্রেরণ করবেন। বর্ণিত আছে- সেই রোগের ফলে তাদের গর্দানে এক ধরনের পোকা সৃষ্টি হবে, ফলে অল্প সময়ের মধ্যে ইয়াজুজ মাজুজের গোষ্ঠী সবাই মরে যাবে। তাদের অসংখ্য মৃত দেহের পচা দুর্গন্ধ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে, তখন ঈসা (আঃ) ও তাঁর সঙ্গীদের দুআয় আল্লাহ তাআলা এক ধরনের বিরাটকায় পাখী প্রেরণ করবেন, যাদের ঘাড় হবে উটের ঘাড়ের মত। তারা মৃতদেহ গুলো উঠিয়ে নিয়ে সাগরে বা যেখানে আল্লাহর ইচ্ছা ফেলে দিবে। তারপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং সমস্ত ভূ-পৃষ্ঠ পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আকাশের এক ধরনের ধোঁয়া সম্বন্ধে আকীদা :
হযরত ঈসা (আঃ)-এর ইন্তেকালের পর কয়েকজন নেককার লোক ন্যায়পরায়ণতার সাথে রাজত্ব পরিচালনা করবেন। তারপর ক্রমান্বয়ে ধর্মের কথা কমে যাবে এবং চতুর্দিকে বে-দ্বীনী শুরু হয়ে যাবে। এ সময় আকাশ থেকে এক ধরনের ধোয়া আসবে, যার ফলে মুমিন মুসলমানের সর্দির মত ভাব হবে এবং কাফেররা বেহুশ হয়ে যাবে । ৪০ দিন পর ধোয়া পরিষ্কার হয়ে যাবে।
পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদয়ের আকীদা :
তার কিছুদিন পর একদিন হঠাৎ একটি রাত তিন রাতের পরিমাণ লম্বা হবে । মানুষ ঘুমাতে ঘুমাতে ত্যাক্ত হয়ে যাবে, গবাদি পশু বাইরে যাওয়ার জন্য চিৎকার করতে শুরু করবে । তারপর সূর্য সামান্য আলো নিয়ে পশ্চিম দিক থেকে উদয় হবে। তখন থেকে আর কারও ঈমান বা তওবা কবূল হবে না। সূর্য মধ্য আকাশ পর্যন্ত এসে আবার আল্লাহর হুকুমে পশ্চিম দিকে গিয়েই অস্ত যাবে। তারপর আবার যথারীতি পূর্বের নিয়মে পূর্বদিক থেকে উদয় এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যেতে থাকবে।
দাব্বাতুল আর্দ সম্বন্ধে আকীদা :
পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদয়ের কিছু দিন পর মক্কা শরীফের সাফা পাহাড় ফেটে অদ্ভুত আকৃতির এক জন্তু বের হবে। একে বলা হয় দাব্বাতুল আর্দ (ভূমির জন্তু) এ প্রাণীটি মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। সে অতি দ্রুতবেগে সারা পৃথিবী ঘুরে আসবে। সে মুমিনদের কপালে একটি নূরানী রেখা টেনে দিবে, ফলে তাদের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে যাবে এবং বেঈমানদের নাকের অথবা গর্দানের উপর সীল মেরে দিবে, ফলে তাদের চেহারা মলিন হয়ে যাবে। সে প্রত্যেক মুমিন ও কাফেরকে চিনতে পারবে। এ জন্তুর আবির্ভাব কিয়ামতের সর্বশেষ আলামত সমূহের অন্যতম । এ জন্তুটির আকার-আকৃতি সম্পর্কে ইবনে কাছীরে বিভিন্ন রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করা হয়েছে, যার অধিকাংশই নির্ভারযোগ্য নয়।
কিয়ামতের পূর্বক্ষণে দুনিয়ার অবস্থা ও কিয়ামত সংঘটন সম্বন্ধে আকীদা :
দাব্বাতুল আরদ গায়েব হয়ে যাওয়ার পর দক্ষিণ দিক থেকে একটি আরাম দায়ক বায়ু প্রবাহিত হবে। তাতে ঈমানদারদের বগলে কিছু অসুখ হবে এবং তারা মারা যাবে। দুনিয়ায় কোন ঈমানদার ব্যক্তি ও আল্লাহ আল্লাহ করার বা আল্লাহর নাম নেয়ার কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। সারা দুনিয়ায় হাশী কাফেরদের রাজত্ব চলবে। তারা বায়তুল্লাহ শরীফকে শহীদ করে ফেলবে । কুরআন শরীফ দেল থেকে এবং কাগজ থেকে উঠে যাবে। তারপর হঠাৎ একদিন সিঙ্গায় ফুক দেয়া হবে এবং কিয়ামত সংঘটিত হবে। সিঙ্গার ফুকে প্রথম প্রথম হালকা আওয়াজ হবে। পরে এতে কঠোর ও ভীষণ হবে যে সমস্ত লোক মারা যাবে। জমীন ও আসমান ফেটে যাবে । পূর্বে যারা মরে গেছে তাদের রূহও বেহুশ হয়ে যাবে। সারা দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে ।
ঈছালে ছওয়াব সম্বন্ধে আকীদা :
“ঈছালে ছওয়াব' অর্থ ছওয়াব রেছানী বা ছওয়াব পৌছানো। মৃত মুসলমানদের জন্য কৃত নামায, রোযা, দান-সদকা, তাসবীহ-তাহলীল, তিলাওয়াত ইত্যাদি শারীরিক ও আর্থিক ইবাদতের ছওয়াব পৌছে থাকে। এক মতে ফরয ইবাদতের দ্বারাও ঈছালে ছওয়াব করা যায়। এতে নিজের জিম্মাদারীও আদায় হবে, মৃতও ছওয়াব পেয়ে যাবে ।
দুআর মধ্যে ওছীলা প্রসঙ্গে আকীদা :
দুআ কবুল হওয়ার জন্য নবীদের বা কোন জীবিত বা মৃত নেককার লোকের ওছীলা দিয়ে কিম্বা কোন নেক কাজের ওছীলা দিয়ে দুআ করা জায়েয বরং তা মোস্তাহাব।
জীন সম্বন্ধে আকীদা :
আল্লাহ তা'আলা আগুনের তৈরী এক প্রকার জীব সৃষ্টি করেছেন, যারা আমাদের দৃষ্টির অগোচর, তাদেরকে জীন বলে। তাদের মধ্যে ভাল মন্দ সব রকম হয়। তাদের সন্তানাদিও হয়। তাদের মধ্যে বেশী প্রসিদ্ধ এবং বড় দুষ্ট হল ইবলীস অর্থাৎ শয়তান। জীন মানুষের উপর আছর করতে পারে।
কারামত, কাশফ, এলহাম ও পীর বুযুর্গ সম্বন্ধে আকীদা :
* বুযুর্গ এবং ওলী আউলিয়াদের দ্বারা আল্লাহ সে সব অসাধারণ কাজ দেখিয়ে থাকেন, তাকে বলা হয় কারামত। আর জাগ্রত বা নিদ্রিত অবস্থায় তারা যে সব ভেদের কথা জানতে পারেন বা চোখের অগোচর জিনিসকে দেলের চোখে দেখতে পারেন, তাকে বলা হয় কাশফ ও এলহাম । বুযুর্গদের কারামত ও কাশফ। এলহাম সত্য। মৃত্যুর পরও কোন বুযুর্গের কারামত প্রকাশিত হতে পারে।
* কারামত ও কাশফ এলহাম হয়ে থাকে বুযুর্গ এবং ওলীদের দ্বারা । বুযুর্গ এবং ওলী বলা হয় আল্লাহর প্রিয় বান্দাকে আর শরীয়তের বরখেলাফ করে কেউ আল্লাহর প্রিয় তথা ওলী বা বুযুর্গ হতে পারে না, অতএব যারা শরীয়তের বরখেলাফ করে যেমন নামায রোযা করে না, গাঁজা, শরাব বা নেশা খায়, বেগানা মেয়েলোককে স্পর্শ করে বা দেখে, গান বাদ্য করে ইত্যাদি, তারা কখনও বুযুর্গ নয়। তারা যদি অলৌকিক কিছু দেখায় তাহলে সেটা কারামত নয় বরং বুঝতে হবে হয় সেটা যাদু বা কোনরূপ তুকতাক ও ভেল্কিবাজী, কিম্বা যে কোন রূপ প্রতারণা। অনেক সময় শয়তান এসব লোকদেরকে গায়েব জগতের অনেক খবর জানিয়ে দেয়, যাতে করে এটা শুনে মূর্খ লোকেরা তাদের ভক্ত হয়ে যায় এবং এভাবে তারা বিভ্রান্তির শিকার হয়। এসব দেখে তাদের ধোকায় পড়া যাবে না।
* কাশফ এবং এলহাম যদি শরীয়তের মোয়াফেক হয় তাহলে তা গ্রহণ যোগ্য, অন্যথায় তা গ্রহণযোগ্য নয়।
* কোন বুযুর্গ বা পীর সম্বন্ধে এই আকীদা রাখা শিরক যে, তিনি সব সময় আমাদের অবস্থা জানেন।
* কোন পীর বুযুর্গকে দূর দেশ থেকে ডাকা এবং মনে করা যে তিনি জানতে পেরেছেন—এটা শিরক । কোন পীর বুযুর্গ গায়েব জানেন না, তবে কখনও কোন বিষয়ে তাদের কাশফ এলহাম হতে পারে, তাও আল্লাহর ইচ্ছার উপর নিশীল ।
* কোন পীর বুযুর্গের হাতে বায়আত হলে তিনি নাজাতের ব্যবস্থা করবেনএরূপ আকীদা রাখা গুমরাহী বরং তারা ঈমান ও আমলের পথ দেখাবেন আর এই ঈমান ও আমলই হবে নাজাতের ওছীলা ।
* কোন পীর বুযুর্গের মর্যাদা- চাই সে যতবড় হোক- কোন নবী বা সাহাবী থেকে বেশী বা তাদের সমানও হতে পারে না।
অলী, আবদাল, গওছ, কুতুব ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা :
বুযুর্গানে দ্বীন লিখেছেন যে, মানব জগতে বার প্রকার আউলিয়া বিদ্যমান রয়েছে। যথা :
১. কুতুব : তাকে কুবুল আলম, কুতবুল আকবার, কুবুল এরশাদ ও কুতবুল
আকতাবও বলা হয় । আলমে গায়েবের মধ্যে তাকে আবদুল্লাহ নামে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর দুইজন উযীর থাকেন, যাদেরকে ইমামাইন বলা হয়। ডানের উযীরের নাম আবদুল মালেক এবং বামের উযীরের নাম আবদুর রব। এতদ্ব্যতীত আরও বার জন কুতুব থাকেন, সাতজন সাত একলীমে থাকেন, তাদেরকে কুতুবে একলীম বলা হয়। আর পাঁচ জন ইয়েমেনে থাকেন, তাদেরকে কুতবে বেলায়েত বলা হয় । এই নির্দিষ্ট কুতুবগণ ব্যতীত অনির্দিষ্ট কুতুব প্রত্যেক শহরে এবং প্রত্যেক গ্রামে থাকেন এক এক জন করে।
২. ইমামাইন : এ
সম্পর্কে ব্যাখ্যা উপরে বর্ণিত হয়েছে ।
৩. গওছ : গওছ থাকেন মাত্র একজন । কেউ কেউ বলেছেন কুতুবকেই গওছ বলা হয়। কেউ কেউ বলেন গওছ ভিন্ন একজন, তিনি মক্কা শরীফে থাকেন।
৪. আওতাদ : আওতাদ চারজন, পৃথিবীর চার কোণে চার জন থাকেন ।
৫. আবদাল : আবদাল থাকেন ৪০ জন।
৬. আখইয়ার : তারা থাকেন পাঁচশত জন কিম্বা সাতশত জন। পৃথিবীর বিভিন্ন
স্থানে তারা ভ্রমণ করতে থাকেন। তাদের নাম হোছাইন।
৭. আবরার : অধিকাংশ বুযুর্গানে দ্বীন আদালগণকেই আবরার বলেছেন।
৮. নুকাবা : নুকাবা আলী নামে ৩০০ জন পশ্চিম দেশে থাকেন।
৯. নুজাবা : নুজাবা হাছান নামে ৭০ জন মিসরে থাকেন।
১০, অমূদ : আমূদ মুহাম্মদ নামে চার জন পৃথিবীর চার কোণে থাকেন।
১১. মুফাররিদ : গওছ উন্নতি করে ফরদ বা মুফাররিদ হয়ে যান। আর ফরদ উন্নতি করে কুতবুল অহদাৎ হয়ে যান।
১২. মাকতুম : মাকতুম শব্দের অর্থ পুশিদা বা লুকায়িত। অর্থ যেমন তারাও তেমনিই পুশিদা থাকেন
উল্লেখ্য যে, অলীদের এই প্রকার এবং এই বিবরণ সম্বন্ধে কুরআন হাদীসে খুলে কিছু বলা হয়নি, শুধু বুযুর্গানে দ্বীনের কাশফের দ্বারা এটা জানা গিয়েছে। আর কাশফ যার হয় তার জন্য সেটা দলীল-অন্যদের জন্য সেটা দলীল হয় না। অতএব এগুলো নিয়ে বেশী ঘাটাঘাটি না করাই শ্রেয় ।
মাজার সম্বন্ধে আকীদা :
মাজার' শব্দের অর্থ জিয়ারতের স্থান। সাধারণভাবে বুযুর্গদের কবরযেখানে জিয়ারত করা হয়-তাকে মাজার বলা হয়। সাধারণভাবে কবর জিয়ারত দ্বারা বেশ কিছু ফায়দা হয় যেমন কলব নরম হয়, মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়, আখেরাতের চিন্তা বৃদ্ধি পায় ইত্যাদি। বিশেষভাবে বুযুর্গদের কবর জিয়ারত করলে তাদের রূহানী ফয়যও লাভ হয় । মাজারের এতটুকু ফায়দা অনস্বীকার্য, কিন্তু এর অতিরিক্ত সাধারণ মানুষ মাজার ও মাজার জিয়ারত সম্পর্কে এমন কিছু গলত ও ভ্রান্ত আকীদা রাখে, যার অনেকটা শিরক-এর পর্যায়ভুক্ত, যেগুলো অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যেমন-
মাজার সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা সমূহ :
১. মাজারে গেলে বিপদ-আপদ দূর হয়।
২. মাজারে গেলে আয়-উন্নতিতে বরকত হয় ।
৩. মাজারে গেলে ব্যবসা-বাণিজ্যে লাভ বেশী হয় ।
৪. মাজারে সন্তান চাইলে সন্তান লাভ হয়।
৫. মাজারে গেলে মকসুদ হাছেল হয়।
৬. মাজারে মান্নত মানলে উদ্দেশ্য পূরণ হয়।
৭. মাজারে টাকা-পয়সা, নর-নিয়াজ দিলে ফায়দা হয় ।
৮, মাজারে ফুল, মোমবাতি, আগরবাতি ইত্যাদি দেয়াকে ছওয়াবের কাজ মনে করা ইত্যাদি।
সাহাবীদের সম্বন্ধে আকীদা :
সকল সাহাবী আদিল অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য, সত্যবাদী, মুত্তাকী, পরহেযগার, ন্যায়পরায়ণ এবং ইসলাম ও উম্মতের স্বার্থকে ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে স্থান দানকারী। প্রত্যেক সাহাবীর মধ্যে হেদায়েতের নূর এবং আলো রয়েছে-কারও মধ্যে অন্ধকার নেই।
সকল সাহাবী সমালোচনার উর্ধ্বে। তাদের সমালোচনা করা, দোষত্রুটি অন্বেষণ করা সম্পূর্ণ অমার্জনীয় অপরাধ । সাহাবীদের সমালোচনাকারীগণ ফাসেক ফাজের ও গুমরাহ।
সাহাবীদের প্রতি মহব্বত ও ভক্তি শ্রদ্ধা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্যতম শিয়ার বা প্রতীক।
প্রত্যেক সাহাবী সত্যের মাপকাঠি, সাহাবায়ে কেরামের ঈমান ঈমানের কষ্টিপাথর, যার নিরিখে অবশিষ্ট সকলের ঈমান পরীক্ষা করা হবে। আমল এবং দ্বীনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁরা মাপকাঠি। সাহাবায়ে কেরাম হকের মাপকাঠি, তাদের নিরিখে নির্ণিত হবে পরবর্তীদের হক বা বাতিল হওয়া।
যে সব ক্ষেত্রে সাহাবীদের মধ্যে দ্বিমত বা বাহ্যিক বিরোধ দেখা দিয়েছে, সে সব ক্ষেত্রেও প্রত্যেক সাহাবী হক ছিলেন। তাদের পারস্পরিক যুদ্ধ বিগ্রহ এবং সংঘর্ষের ক্ষেত্রে মানুষ হিসেবে কোন পক্ষের এজতেহাদী ভুলচুক থাকতে পারে তবে প্রত্যেকের নিয়ত সহীহ ছিল, ব্যক্তি স্বার্থ কিম্বা ব্যক্তিগত আক্রোশে তারা সেটা করেননি বরং দ্বীনের খাতিরে এবং এখলাছের সাথেই করেছেন, এই আকীদা-বিশ্বাস রাখতে হবে। এরূপ ক্ষেত্রেও যে কোন একজন বা এক পক্ষের অনুসরণ করলে হেদায়াত, মুক্তি ও নাজাত পাওয়া যাবে। কিন্তু একজনের অনুসরণ করে অন্যজনের দোষ চর্চা করা যাবে না। দোষ চর্চা হারাম হবে।
সাহাবীদের মর্যাদা সমস্ত ওলী আউলিয়াদের উর্ধ্বে । উম্মতের সবচেয়ে বড় ওলী (যিনি সাহাবী নন) তার মর্যাদাও একজন নিম্ন স্তরের সাহাবীর মর্যাদার সমান হতে পারে না বরং সাহাবী আর সাহাবী নন- এমন দুই স্তরের মধ্যে মর্যাদার তুলনাই অবান্তর।
সমস্ত সাহাবার মধ্যে চারজন সর্বপ্রধান । তন্মধ্যে সর্বপ্রথম (১) হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এবং তিনি প্রথম খলীফা। তারপর (২) হযরত ওমর (রাঃ)। তিনি দ্বিতীয় খলীফা । তারপর (৩) হযরত উসমান গনী (রাঃ)। তিনি তৃতীয় খলীফা (৪) হযরত আলী (রাঃ)। তিনি চতুর্থ খলীফা। খলীফা হওয়ার ক্ষেত্রে এই তারতীব হক ও যথার্থ ।
সকল সাহাবীর প্রতি আল্লাহ তা'আলা চির সন্তুষ্টির
খোশ-খবরী দান করেছেন। বিশেষভাবে একসাথে নবী (সঃ) এর দ্বারা দশজন সাহাবীর নাম উল্লেখ পূর্বক তাদের জান্নাতী হওয়ার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। উক্ত দশজনকে আশারায়ে মুবাশশারাহ (সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন) বলা হয়। তাঁরা হলেন (১) আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) (2) ওমর (রাঃ) (৩) ওছমান (রাঃ) (৪) আলী (রাঃ) (৫) তালহা (রাঃ) (৬) যোবায়ের (রাঃ) (৭) আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) (৮) সাআদ ইবনে আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) (৯) সাঈদ ইবনে যায়েদ (রাঃ) (১০) আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ (রাঃ)।
এছাড়াও রসূল (সঃ) আরও কতিপয় সাহাবী সম্পর্কে বিছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে জান্নাতী হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করেছেন।
রাসূল (সঃ)-এর বিবি ও আওলাদগণের সম্বন্ধে আকীদা :
রাসূল (সঃ)-এর আওলাদগণের মধ্যে হযরত ফাতেমা (রাঃ) এবং বিবিদের মধ্যে হযরত খাদীজা (রাঃ) ও হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর মর্তবা সবচেয়ে বেশী ।
আসবাব/বস্তুর ক্ষমতা সম্বন্ধে আকীদা:
কোন আসবাব বা বস্তুর নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। কোন আসবাব বা বস্তুর নিজস্ব ক্ষমতা আছে- এরূপ বিশ্বাস করা শিরক। তবে বস্তুর মধ্যে যে ক্ষমতা দেখা যায় বা বস্তু থেকে যে প্রভাব প্রকাশ পায় তা আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক প্রদত্ত, তার নিজস্ব ক্ষমতা নয়। তাই আল্লাহ ক্ষমতা না দিলে বা তার স্বাভাবিক কার্যকারিতা প্রকাশ পাবে না- আল্লাহ পাকের এরূপ ফয়সালা হলেই বস্তুর স্বাভাবিক ক্ষমতা ও প্রভাব প্রকাশ পায় না। বস্তু সম্বন্ধে এ হচ্ছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা।
আসবাব গ্রহণের বিধান সম্পর্কে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
রোগ সংক্রমণ সম্বন্ধে আকীদা:
সাধারণতঃ ছোঁয়াচে রোগ বা সংক্রামক ব্যাধি সম্বন্ধে যে ধারণা রয়েছে সে সম্বন্ধে ইসলামের আকীদা হল- কোন রোগের মধ্যে সংক্রমণের নিজস্ব ক্ষমতা নেই। তাই দেখা যায় তথাকথিত সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত লোকের কাছে যাওয়ার পরও অনেকে আক্রান্ত হয় না, আবার অনেকে না যেয়েও আক্রান্ত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে সহীহ আকীদা হলঃ রোগের মধ্যে সংক্রমণ বা অন্যের মধ্যে বিস্তৃত হওয়ার নিজস্ব ক্ষমতা নেই। কেউ অনুরূপ রোগীর সংস্পর্শে গেলে যদি তার আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর ফয়সালা হয়, সে ক্ষেত্রেই সে আল্লাহর হুকুমে আক্রান্ত হবে, অন্যথায় নয় । কিম্বা এরূপ আকীদা রাখতে হবে যে, এসব রোগের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে আল্লাহ তা'আলা সংক্রমণের এই নিয়ম রেখে দিয়েছেন। তবে আল্লাহর ইচ্ছা হলে সংক্রমণ নাও ঘটতে পারে। অর্থাৎ, সংক্রমণের এ ক্ষমতা রোগের নিজস্ব ক্ষমতা নয়, এর পশ্চাতে আল্লাহর দেয়া ক্ষমতা এবং তাঁর ইচ্ছার দখল থাকে। তবে ইসলাম প্রচলিত এসব সংক্রামক রোগে আক্রান্ত লোকদের নিকট যেতে নিষেধ করেছে বিশেষভাবে কুষ্ট রোগীর নিকট, এ কারণে যে, উক্ত রোগীর নিকট গেলে আর তার আক্রান্ত হওয়ার খোদায়ী ফয়সালা হওয়ার কারণে সে আক্রান্ত হলে তার ধারণা হতে পারে যে, উক্ত রোগীর সংস্পর্শে যাওয়ার কারণেই সে আক্রান্ত হয়েছে, এভাবে তার আকীদা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তা যেন হতে না পারে এজন্যেই ইসলাম এরূপ বিধান দিয়েছে। তবে কেউ মজবুত আকীদার অধিকারী হলে সে অনুরূপ রোগীর নিকট যেতে পারে। এমনিভাবে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত লোককেও সুস্থ এলাকার লোকদের নিকট যেতে নিষেধ করেছে, যাতে অন্য কারও আকীদা নষ্টের কারণ না ঘটে।
রাশি ও গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব সম্বন্ধে আকীদা :
রাশি বলা হয় সৌর জগতের কতকগুলো গ্রহ নক্ষত্রের প্রতীককে। এগুলো কল্পিত। এরূপ বারটি রাশি কল্পনা করা হয় যথাঃ মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন। এগুলোকে বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্রের প্রতীক সাব্যস্ত করা হয়েছে। জ্যোতিষশাস্ত্র (অর্থাৎ, ফলিত জ্যোতিষ বা Astrology) -এর ধারণা অনুযায়ী এ সব গ্রহ নক্ষত্রের গতি, স্থিতি ও সঞ্চারের প্রভাবে ভবিষ্যত শুভ-অশুভ সংঘটিত হয়ে থাকে। নিউমারোলজি বা সংখ্যা জ্যোতিষের উপর ভিত্তি করে এই শুভ-অশুভ নির্ণয় তথা ভাগ্য বিচার করা হয়। | ইসলামী আকীদা অনুসারে গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যে নিজস্ব কোন প্রভাব বা ক্ষমতা নেই। সুতরাং ভাগ্য তথা শুভ অশুভ গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাবে ঘটে- এই আকীদা রাখা শিরক। গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যে আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত এরূপ কোন প্রভাব থাকলে থাকতেও পারে কিন্তু তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যা কিছু বলা হয় সবই কাল্পনিক । যদি প্রকৃতই এরূপ কোন প্রভাব থাকেও, তবুও তা আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত-গ্রহ নক্ষত্রের নিজস্ব ক্ষমতা নয়। অতএব শুভ অশুভ মৌলিকভাবে আল্লাহরই ইচ্ছাধীন ও তাঁরই নিয়ন্ত্রণে ।
হস্ত রেখা বিচার সম্বন্ধে আকীদা :
পামিস্ট্রি (Palmistry)
বা হস্তরেখা বিচার বিদ্যার মাধ্যমে যে হাতের রেখা ইত্যাদি দেখে ভাগ্যের বিষয় ও ভূত-ভবিষ্যতের শুভ-অশুভ সম্পর্কে বিশ্লেষণ দেয়া হয়, ইসলামে এরূপ বিষয়ে বিশ্বাস রাখা কুফরী।
রত্ন ও পাথরের প্রভাব সম্বন্ধে আকীদা :
মণি, মুক্তা, হিরা, চুনি, পান্না, আকীক প্রভূতি পাথর ও রত্ন মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে, মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন ঘটাতে পারে- এরূপ আকীদা বিশ্বাস রাখা মুশরিকদের কাজ, মুসলমানদের নয় ।
তাবীজ ও ঝাড়-ফুক সম্বন্ধে আকীদা :
তাবীজ ও ঝাড়-ফুকে কাজ হওয়াটা নিশ্চিত নয়-হতেও পারে নাও হতে পারে। যেমন দুআ করা হলে রোগ ব্যাধি আরোগ্য হওয়াটা নিশ্চিত নয়-আল্লাহর ইচ্ছা হলে আরোগ্য হয় নতুবা হয় না, তদ্রপ তাবীজ এবং ঝাড় ফুকও একটি দুআ বরং তাবীজের চেয়ে দুআ বেশী শক্তিশালী। তাবীজ এবং ঝাড়-ফুকে কাজ হলেও সেটা তাবীজ বা ঝাড় ফুঁকের নিজস্ব ক্ষমতা নয় বরং আল্লাহর ইচ্ছাতেই সব কিছু হয়ে থাকে।
সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব তাবীজ ও ঝাড়-ফুকই এজতেহাদ এবং অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত, কুরআন ও হাদীছে যার ব্যাপারে স্পষ্ট বলা হয়নি যে, অমুক তাবীজ বা অমুক ঝাড়-ফুক দ্বারা অমুক কাজ হবে। অতএব কোন তাবীজ বা ঝাড়-ফুক দ্বারা কাঙ্খিত ফল লাভ না হলে এরূপ বলার বা এরূপ ভাবার অবকাশ নেই যে, কুরআন হাদীছ কি তাহলে সত্য নয় ?
তাবীজ ও ঝাড়-ফুক কুরআন হাদীছের বাক্যাবলী দ্বারা বৈধ উদ্দেশ্যে করা হলে তা জায়েয । পক্ষান্তরে কোন কুফর শিরকের কথা থাকলে বা এরূপ কোন জাদু হলে তা দ্বারা তাবীজ ও ঝাড়-ফুক হারাম । এমনিভাবে কোন অবৈধ উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য তাবীজ ও ঝাড়-ফুক করা হলে তাও জায়েয নয়, যদিও কুরআন হাদীছের বাক্য দ্বারা তা করা হয় ।
যে সব বাক্য বা শব্দ কিম্বা যে সব নকশার অর্থ জানা যায় না তা দ্বারা তাবীজ ও ঝাড়-ফুক করা বৈধ নয়।
কোন বিষয়ের তাবীজ বা ঝাড়-ফুকের জন্য কোন নির্দিষ্ট দিন বা সময় রয়েছে বা বিশেষ কোন শর্ত ইত্যাদি রয়েছে- এরূপ মনে করা ঠিক নয়।
তাবীজ বা ঝাড়-ফুকের জন্য কারও এজাযত প্রাপ্ত হওয়া জরুরী। এরূপ ধারণাও ভুল।
* তাবীজ বা ঝাড়-ফুক দ্বারা ভাল আছর হলে সেটাকে তাবীজ দাতার বা আমেলের বুযুর্গী মনে করা ঠিক নয়। যা কিছু হয় আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়।
নজর ও বাতাস লাগা সম্বন্ধে আকীদা:
* হাদীছের বর্ণনা অনুযায়ী নজর লাগার বিষয়টি সত্য, জান-মাল ইত্যাদির প্রতি বদনজর লেগে তার ক্ষতি সাধন হতে পারে । আপনজনের প্রতিও আপন জনের বদনজর লাগতে পারে, এমনকি সন্তানের প্রতিও মাতা-পিতার বদনজর লাগতে পারে। আর বাতাস লাগার অর্থ যদি হয় জিন ভূতের বাতাস অর্থাৎ তাদের খারাপ নজর বা খারাপ আছর লাগে তাহলে এটাও সত্য; কেননা জিন ভূত মানুষের উপর আছর করতে সক্ষম।
* কেউ কারও কোন ভাল কিছু দেখলে যদি (মাশা আল্লাহ) বলে, তাহলে তার প্রতি তার বদনজর লাগে না। আর কারও উপর কারও বদনজর লেগে গেলে যার নজর লাগার সন্দেহ হয় তার মুখ, হাত (কনুই সহ) হাঁটু এবং এস্তেনজার জায়গা ধুয়ে সেই পানি যার উপর নজর লেগেছে তার উপর ঢেলে দিলে খোদা চাহেতো ভাল হয়ে যাবে। এ সম্পর্কিত আর একটি নিয়ম জানার
বদনজর থেকে হেফাজতের জন্য কাল সুতা বাধা বা কালি কিম্বা কাজলের টিপ লাগালো ভিত্তিহীন ও কুসংস্কার ।
কুলক্ষণ ও সুলক্ষণ সম্বন্ধে আকীদা:
ইসলামী আকীদা মতে কোন বস্তু বা অবস্থা থেকে কুলক্ষণ গ্রহণ করা বা কোন সময়, দিন ও মাসকে খারাপ মনে করা বৈধ নয়। এমনিভাবে কুরআন হার্দীছ দ্বারা-এরূপ কোন লক্ষণ মানা বৈধ নয়। তবে কেউ কোন বিষয়ে চিন্তা ভাবনা বা দুশ্চিন্তায় রয়েছে এরুপ মুহুর্তে ঘটনাক্রমে বা কিছুটা ইচ্ছাকৃতভাবে খুশী বা সাফল্য সূচক কোন শব্দ শুতিগোচর হলে কি এরূপ কিছু দৃষ্টিগোচর হলে সেটাকে সুলক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। এটা মূলতঃ কোন শব্দ বা বস্তুর প্রভাবকে বিশ্বাস করা নয়—এটা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর রহমতের আশাকে শক্তিশালী করা।
শরীয়তের আকীদা বিরুদ্ধ কয়েকটি লক্ষণ ও কুলক্ষণের তালিকা :
১. হাতের তালু চুলকালে অর্থ-কড়ি আসবে মনে করা।
২. চোখ লাফালে বিপদ আসবে মনে করা ।
৩. কুকুর কাঁদলে রোগ বা মহামারী আসবে মনে করা।
৪. এক চিরনিতে দু’জন চুল আঁচড়ালে উক্ত দু'জনের মধ্যে ঝগড়া লাগবে মনে করা।
৫. কোন বিশেষ পাখি ডাকলে মেহমান আসবে মনে করা ।
৬. যাত্রা পথে পেছন থেকে কেউ ডাকলে যাত্রা খারাপ মনে করা।
৭. যাত্রা পথে হোঁচট খেলে বা মেথর দেখলে বা কাল কলসি দেখলে, কিম্বা বিড়াল দেখলে কুলক্ষণ মনে করা । অমুক দিন যাত্রা নাস্তি, অমুক দিন বিবাহ নাস্তি, অমুক দিন ভ্রমণ নাস্তি ইত্যাদি বিশ্বাস করা। মোটকথা কোন দিন সময় বা কোন মুহূর্তকে অশুভ মনে করা।
৮. যাত্রার মুহূর্তে কেউ তার সামনে হাঁচি দিলে কাজ হবে না- এরূপ বিশ্বাস করা।
৯. পেঁচা ডাকলে ঘর-বাড়ি বিরান হয়ে যাবে মনে করা ।
১০. জিহ্বায় কামড় লাগলে কেউ তাকে গালি দিচ্ছে বা কেউ তাকে স্মরণ করছে মনে করা।
১১. চড়ুই পাখিকে বালুতে গোসল করতে দেখলে বৃষ্টি হবে মনে করা ।
১২. দোকান খোলার পর প্রথমেই বাকি দিলে সারা দিন বাকি বা ফাকি যাবে মনে করা।
১৩. কোন লোকের আলোচনা চলছে, ইত্যবসরে বা কিছুক্ষণ পরে সে এসে পড়লে এটাকে তার দীর্ঘজীবি হওয়ার লক্ষণ মনে করা ।
১৪. কোন ঘরে মাকড়সার জাল বেশী হলে উক্ত ঘরের মালিক ঋণগ্রস্থ হয়ে যাবে মনে করা ।
১৫. আসরের পর ঘরে ঝাড়ু দেয়াকে খারাপ মনে করা।
১৬. ঝাড়ু দ্বারা বিছানা পরিস্কার করলে ঘর উজাড় হয়ে যাবে মনে করা ।
১৭. কোন বাড়িতে বাচ্চা মারা গেলে সে বাড়িতে গেলে নিজের বাচ্চাও মারা যাবে মনে করা।
১৮. ঝাড়ুর আঘাত লাগলে শরীর শুকিয়ে যাবে মনে করা ।
১৯, কোন প্রাণী বা কোন প্রাণীর ডাককে অশুভ বা অশুভ লক্ষণ মনে করা। [ বিঃ দ্রঃ এরূপ আরও বহু গলত আকীদা রয়েছে, উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি উল্লেখ করা হল।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত সম্বন্ধে আকীদা :
এক হাদীছে বলা হয়েছে অতিশীঘ্র আমার উম্মত তেহাত্তর ফেকায় (দলে) বিভক্ত হয়ে পড়বে, তন্মধ্যে মাত্র একটি দল হবে মুক্তিপ্রাপ্ত (অর্থাৎ, জান্নাতী) আর বাকী সবগুলো ফের্কা হবে জাহান্নামী। জিজ্ঞাসা করা হল ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেই মুক্তি প্রাপ্ত দল কারা ? রাসূল (সঃ) উত্তরে বললেনঃ তারা হল আমি ও আমার সাহাবীগণ যে মত ও পথের উপর আছি তার অনুসারীগণ । (তিরমিযী, ২য়)
এ হাদীছের মধ্যে যে মুক্তিপ্রাপ্ত বা জান্নাতী দল সম্পর্কে বলা হয়েছে, তাদেরকেই বলা হয় “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত ।" নামটির মধ্যে 'সুন্নাত শব্দ দ্বারা রাসূল (সঃ)-এর মত ও পথ এবং জামাআত শব্দ দ্বারা বিশেষভাবে সাহাবায়ে কিরামের জামাআত উদ্দেশ্য। মোটকথা- রাসূল (সঃ) এবং সাহাবায়ে কিরামের মত ও পথের অনুসারীদেরকেই বলা হয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত । ইসলাম ধর্মে বিভিন্ন সময়ে যে সব সম্প্রদায় ও ফেকার উদ্ভব হয়েছে তন্মধ্যে সর্বযুগে এ দলটিই হল সত্যাশ্রয়ী দল। সর্বযুগে ইসলামের মৌলিক আকাইদ বিষয়ে হকপন্থী গরিষ্ঠ উলামায়ে কেরাম যেভাবে কুরআন, হাদীছ ও সাহাবায়ে কেরামের মত ও পথের অনুসরণ করে আসছে, এ দলটি তারই অনুসরণ করে আসছে। সর্বযুগে এ দলই হচ্ছে বৃহত্তম দল । সর্বযুগে এরা টিকে আছে। এর বাইরে যারা গিয়েছে, তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বহির্ভূত বিপথগামী ও বাতিলপন্থী সম্প্রদায়। এরূপ বহু বাতিল সম্প্রদায় কালের অতল গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, যারা রয়েছে তারাও বিলীন হবে, হকপন্থী দল চিরকাল টিকে থাকবে।
No comments