ঈমান কাকে বলে ও কি কি বিষয়ের উপর ঈমান আনতে হয়। Islamic Media Blog
![]() |
Iman & Akidha |
ঈমান ও আকাইদ
“ঈমান হচ্ছে সমস্ত আমলের বুনিয়াদ । যার ঈমান নেই তার কোন আমল কবুল হয় না।যারা কাফের (অর্থাৎ, যাদের ঈমান ঠিক নেই। তাদের আমলসমূহ মরু ভূমির মরীচিকার ন্যায়।” (সূরা নূরঃ ৩৯)
কয়েকটি পরিভাষার অর্থ:
* ঈমান : “ঈমান” শব্দের শাব্দিক অর্থ বিশ্বাস করা, স্বীকার করা, ভরসা করা, নিরাপত্তা প্রদান করা ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় ঈমান বলা হয় রাসূল (সঃ) কর্তৃক আনীত ঐ সকল বিষয়াদি যা স্পষ্ট ভাবে এবং অবধারিত রূপে প্রমাণিত, সে সমুদয়কে রাসূল (সঃ)-এর প্রতি আস্থাশীল হয়ে বিশ্বাস করা এবং মুখে তা স্বীকার করা (যদি স্বীকার করতে বলা হয়। আর কুরআন হাদীছ এবং সাহাবায়ে কেরাম ও উম্মতের সর্বসম্মত ব্যাখ্যা অনুযায়ী ধর্মের অবধারিত (বদীহী) বিষয় গুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করা। সংক্ষেপে ও সাধারণ ভাবে ইসলামের ধর্মীয় বিশ্বাসকে ঈমান বলা হয় ।
* মু'মিন : যার মধ্যে ঈমান আছে তাকে মু'মিন বলা হয়।
* ইসলাম: “ইসলাম” শব্দের শাব্দিক অর্থ মেনে নেয়া, আনুগত্য করা। শরীয়তের পরিভাষায় ইসলাম বলা হয় (ঈমান সহ) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যকে মেনে নেয়। সংক্ষেপে ও সাধারণ ভাবে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) আনীত ধর্মকে ইসলাম বলা হয় বা ধর্মীয় কর্মকে ইসলাম বলা হয় ।
বিঃ দ্রঃ ঈমান ও ইসলাম' শব্দ দুটো সমার্থবোধক ভাবেও ব্যবহৃত হয়ে
* মুসলমান/মুসলিম : ইসলাম ধর্ম অনুসারীকে মুসলমান বা মুসলিম বলা হয়।
* কুফর : যে সব বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস রাখাকে ঈমান বলা হয়, প্রকাশ্যে তার কোন কিছুকে মুখে অস্বীকার করা বা তার প্রতি অন্তরে অবিশ্বাস রাখা হল কুফর।।
* কাফের : যার মধ্যে কুফর থাকে সে হল কাফের।
* শিরক : আল্লাহর যাত (সত্তা) তাঁর ছিফাত (গুণাবলী) এবং তাঁর ইবাদতে কাউকে শরীক বা অংশীদার বানানো হল শিরক।
• মুশরিক: যে শিরক করে তাকে বলা হয় মুশরিক।
* নেফাক/মুনাফেকী : মুখে ঈমান প্রকাশ করা, প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করা অথচ অন্তরে কুফর প্রচ্ছন্ন রাখা—এরূপ কপটতাকে বলা হয় নেফাক বা মুনাফেকী ।
মুনাফেক : যে মুনাফেকী করে তাকে বলা হয় মুনাফেক ।
মুলহিদ/যিনদীক : যে মৌখিক ভাবে ও প্রকাশ্যে ইসলাম এবং ঈম্মান-এর অনুসারী কিন্তু নামায, রোযা, হজ, যাকাত, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি বদীহা ও অবধারিত বিষয় গুলোর এমন ব্যাখ্যা দেয়, যা কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট বর্ণনা বিরুদ্ধ, এরূপ লোক প্রকৃত মু'মিন মুসলমান নয়, কুরআনের পরিভাষায় তাকে বলা হয় মুহিদ আর হাদীছের পরিভাষায় তাকে বলা হয় যিনদীক। কারও কারও ব্যাখ্যা মতে সব ধরনের ধর্ম বিরোধী বা মুশরিকদেরকেও যিনদীক বলা হয়। যারা দাহরী বা নাস্তিক, তাদেরকেও যিনদীক বলা হয়ে থাকে।
* মুরতাদ : ইসলাম ধর্মের অনুসারী কোন ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করলে কিম্বা ঈমান পরিপন্থী কোন কথা বললে বা কাজ করলে তাকে মুরতাদ বলে।সংক্ষেপে মুরতাদ অর্থ ধর্মত্যাগী।
* ফাসেক: প্রকাশ্যে যে ব্যক্তি গোনাহে কবীরা করে বেড়ায় তাকে বলে ফাসেক। আবার ব্যাপক অর্থে সব ধরনের অবাধ্যকে ফাসেক বলা হয়, এ হিসেবে একজন কাফেরকেও ফাসেক বলা হতে পারে, যেহেতু সেও অবাধ্য।
আকীদাঃ “আকীদা"-এর শাব্দিক অর্থ কোন বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা। ইসলামের পরিভাষায় আকীদা অর্থ দৃঢ় ও মজবুত ঈমান, অকাট্য প্রমাণ ভিতিক খবরাখবর ও বিষয়াবলীর প্রতি মনের অটল বিশ্বাস। "আকীদা" শব্দের বহুবচন হল আকাঈদ। এ'তেকাদ শব্দটিও আকীদা অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এতেকাদ শব্দের বহুবচন এ'তেকাদাত।
যে সব বিষয়ে ঈমান রাখতে হয়
১। “আল্লাহ''-এর উপর ঈমান :
আল্লাহ তাআলার উপর ঈমান বলতে মৌলিক ভাবে তিনটি বিষয় বিশ্বাস করা ও মেনে নেয়াকে বুঝায়
(ক) আল্লাহর সত্তা ও তাঁর অস্তিত্বে বিশ্বাস করা।
(খ) আল্লাহর ছিফাত অথাৎ গুণাবলীতে বিশ্বাস করা। আল্লাহর গুণাবলী তাঁর গুণবাচক নাম সমূহে ব্যক্ত হয়েছে। (দেখুন ৪৯-৫০ পৃষ্ঠা)
(গ) তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করা। এই তাওহীদ বা একত্ব আল্লাহর সত্তার ক্ষেত্রে যেমন, তাঁর গুণাবলী ও ইবাদতের ক্ষেত্রেও তেমন অথাৎ, আল্লাহর সত্তা যেমন এক-তাঁর সত্তায় কেউ শরীক নেই, তেমনি ভাবে তাঁর গুণাবলীতেও কেউ শরীক নেই এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে হবে, ইবাদতে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করা যাবেনা।
তাওহীদের বিপরীত হল শিরক। অতএব একাধিক মা'বুদে বিশ্বাস করা শিরক। যেমন অগ্নিপূজক সম্প্রদায় কল্যাণের মা’বূদ হিসেবে ‘ইয়াযদান' এবং অকল্যাণের মা'বুদ হিসেবে ‘আহরামান'-কে বিশ্বাস করে এটা শিরুক। এমনিভাবে খৃষ্টানরা তিন খোদা মানে। হিন্দুগণ ব্রক্ষাকে সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণুকে পালনকর্তা এবং মহাদেবকে সংহারকর্তা বলে মানে; এভাবে তারা একাধিক ভগবানে বিশ্বাসী। এছাড়াও তারা বহু দেবদেবীতে বিশ্বাস করে, এটা শিরুক ।
এমনি ভাবে আল্লাহর গুণাবলীতে কোন সৃষ্টিকে শরীক করা, যেমন মানুষের কোন কল্যাণ সাধন কিম্বা বিপদ মোচন ইত্যাদি বিষয়ে কোন সৃষ্টিকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত মনে করা, এটা শিরুক।
এমনি ভাবে আল্লাহর সাথে ইবাদতে কাউকে শরীক করাও শিরক, যেমন জলের (অর্থাৎ গম্বার), সূর্যের, রামের, যীশুর, দেবতা ইত্যাদির পূর্জা করা শিরক।
২।ফেরেশতা সম্বন্ধে ঈমান:
ফেরেশতা সম্বন্ধে এই বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ এক প্রকার নূরের মাকলুক সৃষ্টি করেছেন যারা পুরুষও নয় নারীও নয়। যারা কাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি রিপু থেকে মুক্ত । যারা নিস্পাপ । আল্লাহর আদেশের বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম তারা করে না। তারা বিভিন্ন আকার ধারণ করতে পারে। তারা সংখ্যায় অনেক। আল্লাহ তাদেরকে বিপুল শক্তির অধিকারী বানিয়েছেন। আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করে বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন- কতিপয় আযাবের কাজে, রহমতের কাজে নিযুক্ত আছে, কতিপয় আমলনামা লেখার কাজে নিযুক্ত, তাদেরকে "কিরামান কাতিবীন" বলা হয় । এমনি ভাবে সৃষ্টির বিভিন্ন কাজে ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ নিয়োজিত করে রেখেছেন।
ফেরেশতাদের মধ্যে চারজন সর্বপ্রধান :
(এক) জিব্রাইল ফেরেশতা : তিনি ওহী ও আল্লাহর আদেশ বহন করে নবীদের নিকট আনতেন । এছাড়া আল্লাহ যখন যে নির্দেশ প্রদান করেন তা কর্তব্যরত ফেরেশতার নিকট পৌঁছান।
(দুই) মীকাঈল ফেরেশতা : তিনি মেঘ প্রস্তুত করা ও বৃষ্টি বর্ষন এবং আল্লাহর নির্দেশে মাখলুকের জীবিকা সরবরাহের দায়িত্বে নিযুক্ত।
(তিন) ইসরাফীল ফেরেশতা : তিনি রূহ সংরক্ষণ ও সিঙ্গায় ফুঙ্কার দিয়ে দুনিয়াকে ভাঙ্গা ও গড়ার কাজে নিযুক্ত।
(চার) আযরাঈল ফেরেশতা : জীবের প্রাণ হরণের কাজে নিযুক্ত তিনি। তাকে মালাকুল মউত"ও বলা হয় । রূহ কবয করার সময় তাকে কারও কাছে আসতে হয়না বরং সারা পৃথিবী একটি গ্লোবের ন্যায় তার সামনে অবস্থিত, যার আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যায় নিজ স্থানে থেকেই তিনি তার রূহ কবয করে নেন। তবে মৃত ব্যক্তি নেককার হলে রহমতের ফেরেশতা আর বদকার হলে আযাবের ফেরেশতা মৃতের নিকট এসে থাকেন এবং মৃত ব্যক্তির রূহ নিয়ে যান।
৩।নবী ও রাসূল সম্বন্ধে ঈমান:
জীন ও ইনছানের হেদায়েতের জন্য আল্লাহ আসমান থেকে যে কিতাব প্রেরণ করেন, সেই কিতাবের ধারক বাহক বানিয়ে, সেই কিতাব বুঝানো ও ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য তথা আল্লাহর বাণী হুবহু পৌছে দেয়ার জন্য এবং আমল করে আদর্শ দেখানোর জন্য আল্লাহ নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং জীন ও মানব জাতির নিকট তাদেরকে প্রেরণ করেছেন। তাদেরকে বলা হয় নবী বা পয়গম্বর। এই নবীদের মধ্যে বিশেষভাবে যারা নতুন কিতাব প্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁদেরকে বলা হয় রাসূল, আর যারা নতুন কিতাব প্রাপ্ত হননি বরং পূর্ববর্তী নবীর কিতাব প্রচারের দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদেরকে শুধু নবী বলা হয়। তবে সাধারণ ভাবে নবী, রাসুল, পয়গম্বর সব শব্দগুলো একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
নবী ও রাসূলদের প্রতি ঈমান রাখার অর্থ হল প্রধানতঃ নিম্নোক্ত বিষয়াবলীতে বিশ্বাস রাখা।
১. নবীগণ নিষ্পাপ-তাদের দ্বারা কোন পাপ সংঘটিত হয় না।
২. নবীগণ মানুষ, তারা খোদা নন বা খোদার পুত্র নন বা খোদার রূপান্তর (অবতার) নন বরং তারা খোদার প্রতিনিধি ও নায়েব-আল্লাহর বাণী অনুসারে জ্বিন ও মানুষ জাতিকে হেদায়েতের জন্য তারা দুনিয়াতে প্রেরিত হন ।
৩. নবীগণ আল্লাহর বাণী হুবহু পৌছে দিয়েছেন।
8, নবীদের ছিলছিলা হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর উপর শেষ হয়েছে।
৫. আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং তিনি খাতামুন্নবী অর্থাৎ, তার পর আর কোন নবী আসবেন না। অন্য কেউ নবী হওয়ার দাবী করলে সে ভণ্ড এবং কাফির।
৬. নবীগণ কবরে জীবিত । আমাদের নবী (সঃ)ও কবরে জীবিত আছেন। তাঁর রওজায় সালাম দেয়া হলে তিনি শুনতে পান এবং উত্তর প্রদান করে থাকেন। অন্য কোন স্থানে থেকে নবীর প্রতি দুরূদ সালাম পাঠ করা হলে নির্ধারিত ফেরেশতারা নবী (সঃ) -এর নিকট তা পৌঁছে দেন।
৭. হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পর্যন্ত যত পয়গম্বর এসেছেন, তাদের সকলেই হক ও সত্য পয়গম্বর ছিলেন, সকলের প্রতিই ঈমান রাখতে হবে। তবে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর আগমনের পর অন্য নবীর শরীয়ত রহিত হয়ে গিয়েছে, এখন শুধু হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর শরীয়ত ও তাঁর আনুগত্যই চলবে ।
৮, নবীদের দ্বারা তাদের সততা প্রমাণিত করার জন্য অনেক সময় অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। এসব অলৌকিক ঘটনাকে 'মু'জেযা' বলে। মু'জেযায় বিশ্বাস করাও ঈমানের অঙ্গীভূত।
৪।আল্লাহর কিতাব সম্বন্ধে ঈমান :
আল্লাহ তাআলা মানব ও জ্বিন জাতির হেদায়াত এবং দিক নির্দেশনার জন্য নবীদের মাধ্যমে তাঁর বাণীসমূহ পৌছে দিয়ে থাকেন। এই বাণী ও আদেশ নিষেধের সমষ্টিকে বলা হয় কিতাব। আল্লাহ তা'আলা যত কিতাব দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তার মধ্যে অনেকগুলো ছিল ছহীফা অর্থাৎ, কয়েক পাতার কিতাব । এক বর্ণনা মতে সর্বমোট ১০৪ খানা কিতাব প্রেরণ করা হয়। তন্মধ্যে চারখানা হল বড় কিতাব । যথা :
(এক) তাওরাত বা তৌরীত : যা হযরত মূছা (আঃ)-এর উপর নাযেল হয়।
(দুই) যরূর : যা হযরত দাউদ (আঃ)-এর উপর নাযেল হয়।
(তিন) ইঞ্জীল : যা হযরত ঈসা (আঃ)-এর উপর নাযেল হয়। উল্লেখ্য যে, আল্লাহর প্রেরিত আসল ইঞ্জীল দুনিয়াতে কোথাও নেই। বর্তমানে ইঞ্জীল বা বাইবেল নামে যে গ্রন্থ পাওয়া যায় তা মূলতঃ হযরত ঈসা (আঃ) কে আল্লাহ তা'আলা উর্ধ্ব আকাশে উঠিয়ে নেয়ার বহু বৎসর পর কিছু লোক রচনা ও সংকলন করেছিল। তারপর যুগে যুগে বিভিন্ন পদী ও খৃষ্টান পণ্ডিতগণ তাতে বহু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন করেছে। ফলে এটিকে কোন ক্রমেই আর আসমানী ইঞ্জীল বলে মেনে নেয়া যায় না বরং এ হল মানুষের মনগড়, বিকৃত এবং মানব রচিত ইঞ্জলি-অসমানী ইঞ্জীল নয় ।
(চার) কুরআন : যা আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর নাযেল হয় । কুরআনকে আল-কুরআন, আল-কিতাব, ফুরকান এবং আল-ফুরকানও বলা হয়।
* আল্লাহর কিতাব বা আসমানী কিতাব সম্বন্ধে ঈমান রাখার অর্থ হল প্রধানতঃ নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিশ্বাস করা :
১. এ সমস্ত কিতাব আল্লাহর বাণী, মানব রচিত নয়।
২. আল্লাহ যেমন অবিনশ্বর ও চিরন্তন, তার বাণীও তদ্রুপ অবিনশ্বর ও চিরন্তন। কুরআন নশ্বর-সৃষ্টি নয়।
৩. আসমানী কিতাব সমূহের মধ্যে কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ।
৪. কুরআন সর্বশেষ কিতাব-এর পর আর কোন কিতাব নাযেল হবে না । কেয়ামত পর্যন্ত কুরআনের বিধানই চলবে। কুরআনের মাধ্যমে অনন্য আসমানী কিতাবের বিধান রহিত হয়ে গিয়েছে।
৫. কুরআনের হেফাজতের জন্য আল্লাহ তাআলা ওয়াদা করেছেন, কাজেই এর পরিবর্তন কেউ করতে পারবে না। কুরআনকে সর্বদা অবিকৃত বলে বিশ্বাস করতে হবে।
৫. আখেরাত সম্বন্ধে ঈমান:
আখেরাত বা পরকাল সম্বন্ধে বিশ্বাস করার অর্থ হল- মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে কবর ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়, হাশর- নশর ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় এবং জান্নাত-জাহানাম ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়- যেগুলো সম্পর্কে ঈমান আনার শিক্ষা দেয়া হয়েছে তার সব কিছুতেই বিশ্বাস করা। অতএব এ পর্যায়ে মোটামুটি ভাবে নিম্নোক্ত বিষয়াবলীতে বিশ্বাস রাখতে হবে।
(এক) কবরের সওয়াল জওয়াব সত্য: কবরে প্রত্যেক মানুষের সংক্ষেপে কিছু পরীক্ষা হবে। মুনকার ও নাকীর নামক দু'জন ফেরেশতা কবরবাসীকে প্রশ্ন করবে তোমার রব কে? তোমার দ্বীন ধর্ম কি? তোমার রাসূল কে? সে নেককার হলে এ প্রশ্নাবলীর উত্তর সঠিকভাবে দিতে সক্ষম হবে। তখন তার কবরের সাথে এবং জান্নাতের সাথে দুয়ার খুলে যোগাযোগ স্থাপন করে দেয়া হবে এবং কিয়ামত পর্যন্ত সে সুখে বসবাস করতে থাকবে। আর সে নেককার না হলে (তুর্থাৎ কাফের বা মুনাফেক হলে) প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তরেই সে বলবে : অর্থাৎ - হায় হায় আমি জানি না! তখন জাহান্নামের ও তার কবরের মাঝে দুয়ার খুলে দেয়া হবে এবং বিভিন্ন রকম শাস্তি তাকে দেয়া হবে।
(দুই) কবরের আযাব সত্যঃ কবর মূলত শুধু নির্দিষ্ট কোন গর্তকে বলা হয় না, কবর বলতে আসলে বোঝায় মৃত্যুর পর থেকে নিয়ে হাশরের ময়দানে পুনজীবিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়কালীন জগতকে। এ জগতকে কবর জগত, আলমে বরযখ বা বরযখের জগত বলা হয়। মৃত্যুর পর মানুষের মরদেহ যেখানেই যেভাবে থাকুক না কেন সে কবর জগতের অধিবাসী হয়ে যায় এবং বদকার হলে তার উপর আযাব চলতে থাকে। কবরের এ আযাব মূলতঃ হয় রূহের উপর এবং রূহের মাধ্যমে দেহও সে আযাব উপলব্ধি করে থাকে। তাই দেহ যেখানেই যেভাবে থাকুক না কেন, জ্বলে পুড়ে ছাই বা পচে গলে মাটি হয়ে যাক না কেন, তার যে অংশ অবশিষ্ট থাকবে সেটুক আযাব উপলব্ধি করবে। আর মৌলিক ভাবে আযাব যেহেতু রূহের উপর হবে, তাই কবরের আযাব হওয়ার জন্য এই দেহ অবশিষ্ট থাকাও অপরিহার্য নয়।
(তিন) পুনরুত্থান: হাশর ময়দানের অনুষ্ঠান সত্য ও কিয়ামতের সময় শিংগায় ফুঁক দেয়ার পর সবকিছু নেস্ত-নাবুদ হয়ে যাবে। আবার আল্লাহর হুকুমে এক সময় শিংগায় ফুক দেয়া হলে আদি অন্তের সব জ্বিন, ইনছান ও যাবতীয় প্রাণী পুনরায় জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানে একত্রিত হবে।
(চার) আল্লাহর বিচার ও হিসাব নিকাশ সত্য : পুনর্জীবিত হওয়ার পর সকলকে আল্লাহ তা'আলার বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।
(পাচ) নেকী ও বদীর ওজন সত্য: কিয়ামতের ময়দানে হিসাব-নিকাশের জন্য মীজান বা দাড়িপাল্লা (মাপযন্ত্র) স্থাপন করা হবে এবং তার দ্বারা নেকী বদী ওজন করা হবে ও ভাল-মন্দ এবং সৎ-অসতের পরিমাপ করা হবে।
(ছয়) আমল নামার প্রাপ্তি সত্য : কিয়ামতের ময়দানে আমল নামা উড়িয়ে দেয়া হবে এবং প্রত্যেকের আমলনামা তার হাতে গিয়ে পড়বে এবং প্রত্যেকে তার জীবনের ভাল-মন্দ যা কিছু করেছে সব তাতে লিখিত অবস্থায় পাবে। নেককারের আমলনামা তার ডান হাতে গিয়ে পৌছবে, আর বদকারের বাম হাতে আমল নামা গিয়ে পড়বে।
(সাত) হাউযে কাউছার সত্যঃ এই উম্মতের মধ্যে যারা পূর্ণভাবে সুন্নাতের পাবন্ধী করবে, কিয়ামতের ময়দানে রাসূল (সঃ) তাদেরকে একটি হাউয থেকে পানি পান করাবেন, যার ফলে আর তাদেরকে পিপাসায় কষ্ট দিবে না। এই হাউকে বলা হয় হাউযে কাউছার।
(আট) পুলসিরাতকে বিশ্বাস করা : হাশরের ময়দানের চতুর্দিক জাহান্নাম দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকবে। এই জাহান্নামের উপর একটি পুল স্থাপন করা হবে, যা চুলের চেয়ে সরু এবং তলেঅয়ারের চেয়ে ধারালো হবে। এটাকে বলা হয় পুলসিরাত। সকলকেই এই পুল পার হতে হবে। এই পুলসিরাত হল দুনিয়ার সিরাতে মুস্তাকীমের স্বরূপ। দুনিয়াতে যে যেভাবে সিরাতে মুস্তাকীমের উপর চলেছে, সে সেভাবে পুলসিরাত পার হয়ে যাবে-কেউ বিদ্যুৎ গতিতে, কেউ চোখের পলকে, কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে, কেউ দৌড়ে, কেউ হেটে, আবার কেউ হামাগুড়ি দিয়ে। মোট কথা, যার যে পরিমাণ নেকী সে সে রকম গতিতে উক্ত পুল পার হবে। আর পাপীদেরকে জাহান্নামের আংটা জাহান্নামের মধ্যে টেনে ফেলে দিবে।
(নয়) শাফায়াত সত্য একথা বিশ্বাস করা : পরকালে রাসূল (সঃ), আলেম, হাফেজ প্রমুখদেরকে বিভিন্ন পর্যায়ে সুপারিশ করার ক্ষমতা দেয়া হবে। রাসূলে কারীম (সঃ) অনেক প্রকারের শাফায়াত বা সুপারিশ করবেন। তন্মধ্যে –
(১) হাশরের ময়দানের কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য। হাশরের ময়দানের কষ্টে সমস্ত মাখলুক যখন পেরেশান হয়ে বড় বড় নবীদের কাছে আল্লাহর নিকট এই মর্মে সুপারিশ করার আবেদন করবে, যেন আল্লাহ পাক বিচারকার্য সমাধান করে হাশরের ময়দানের কষ্ট থেকে সকলকে মুক্তি দেন, তখন সকল নবী অপারগতা প্রকাশ করবেন। কারণ আল্লাহ তা'আলা সেদিন অত্যন্ত রাগান্বিত থাকবেন। অবশেষে রাসূল (সঃ) সেই সুপারিশ করবেন। এটাকে ‘শাফায়াতে কুরা’ বা বড় সুপারিশ বলা হয় ।
(২) কোন কোন কাফেরের আযাব সহজ করার জন্য। যেমন রাসূলের চাচা আবু তালেবের জন্য এরূপ সুপারিশ হবে।
(৩) কোন কোন মুমিনকে জাহান্নাম থেকে বের করার জন্য।
(৪) যে সব মুমিন বদ আমল বেশী হওয়ার কারণে জাহান্নামের যোগ্য হয়েছে- এরূপ মুমিনদের কতকের মাগফেরাতের জন্য ।
(৫) কোন কোন মুমিনকে বিনা হিসেবে বেহেশতে প্রবেশ করানোর জন্য।
(৬) বেহেশতে মুমিনদের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ।
(৭) আ'রাফ তথা জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে অবস্থিত প্রাচীরে যারা অবস্থান করবে তাদের মুক্তির জন্য ।
(দশ) জান্নাত বা বেহেশতকে বিশ্বাস করা : আল্লাহর নেক বান্দাদের জন্য আল্লাহ এমন সব নেয়ামত তৈরী করে রেখেছেন যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শোনেনি, কারও অন্তরে তার পূর্ণ ধারণাও আসতে পারেনা। এই সব মহা নেয়ামতের স্থান হল জান্নাত বা বেহেশত। জান্নাত কোন কল্পিত বিষয় নয় বরং সৃষ্ট রূপে তা বিদ্যমান আছে এবং অনন্ত কাল বিদ্যমান থাকবে। মুমিনগণও অনন্তকাল সেখানে থাকবেন। জান্নাত বা বেহেশত আটটি । যথা - (১) জান্নাতুল খুলদ (২) দারুস সালাম (৩) দারুল কারার (৪) জান্নাতু আদন (৫) জান্নাতুল মাওয়া (৬) জান্নাতুন নাঈম (৭) জান্নাতু ইল্লিয়্যীন বা দারুল মুকামাহ (৮) জান্নাতুল ফিরদাউস।
(এগার) জাহান্নাম বা দোযখকে বিশ্বাস করা : পাপীদেরকে আল্লাহ আগুন ও আগুনের মধ্যে অবস্থিত সাপ, বিচ্ছু, শৃঙখল প্রভৃতি বিভিন্ন শাস্তির উপকরণ দ্বারা আযাব দেয়ার জন্য যে স্থান প্রস্তুত করে রেখেছেন, তাকে বলা হয় জাহান্নাম বা দোযখ। দোযখ আল্লাহর সৃষ্ট রূপে বিদ্যমান রয়েছে এবং অনন্তকাল বিদ্যমান থাকবে। কাফেররা অনন্তকাল তাতে অবস্থান করবে।
জাহান্নামের সাতটি স্তর বা দরজা থাকবে। একেক স্তরের শাস্তির ধরন হবে একেক রকম। অপরাধ অনুসারে যে যে স্তরের উপযোগী হবে তাকে সে স্তরে নিক্ষেপ করা হবে। এ স্তরগুলোর পৃথক পৃথক নাম রয়েছে। যথা- (এক) জাহান্নাম (দুই) লাযা (তিন) হুতামা (চার) সায়ীর (পাঁচ) সাকার (ছয়) জাহীম (সাত) হাবিয়া ।
৬. তাকদীর সম্বন্ধে ঈমান :
ষষ্ট যে বিষয়ে ঈমান রাখতে হয়, তা হল তাকদীরের বিষয়ে ঈমান। “তাকদীর” অর্থ পরিকল্পনা বা নকশা। আল্লাহ তাআলা সবকিছু সৃষ্টি করার পূর্বে সৃষ্টি জগতের একটা নকশাও লিখে রেখেছেন, সবকিছুর পরিকল্পনাও লিখে রেখেছেন, এই নকশা ও পরিকল্পনাকেই বলা হয় তাকদীর। এই পরিকল্পনা এবং নকশা অনুসারেই সবকিছু সংঘটিত হয় এবং হবে । অতএব ভাল মন্দ সবকিছুই আল্লাহর তরফ থেকে এবং তাকদীর অনুযায়ী সংঘটিত হয়। এই বিশ্বাস রাখতে হবে । ভাল এবং মন্দ উভয়টার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ এই বিশ্বাস রাখা অপরিহার্য । এর বিপরীত কেউ যদি ভাল বা ‘সু-র জন্য একজন সৃষ্টিকর্তা আর মন্দ বা “কু'-র জন্য অন্য একজন সৃষ্টিকর্তা মানে তাহলে সেটা ঈমানের পরিপন্থী কুফর ও শিরক হয়ে যাবে। যেমন অগ্নিপূজারীগণ কল্যাণ ও ‘সু'-র সৃষ্টিকর্তা “ইয়াযদান" এবং অকল্যাণ ও “কু"-র সৃষ্টিকর্তা আহরামন'-কে মানে । হিন্দুগণ ‘সু'-র সৃষ্টিকর্তা লক্ষ্মীদেবী এবং কু'-র সৃষ্টিকর্তা শনি দেবতাকে মানে। এটা কুফর ও শিরক।
এখানে এ প্রশ্ন করা যাবে না যে, সবই যখন আল্লাহর পরিকল্পনা অনুসারে হয়, তখন আমলের প্রয়োজন কি, যা হওয়ার তা তো হবেই? এ প্রশ্ন করা যাবে না এ জন্য যে, আল্লাহ তাআলা কর্ম জগতের নকশায় লিখে রেখেছেন যে, যদি মানুষ ইচ্ছা করে তাহলে এরূপ আর যদি ইচ্ছা না করে তাহলে এরূপ । এমনিভাবে আল্লাহ মন্দ-এর সৃষ্টিকর্তা হলেও তিনি দায়ী নন বরং মানুষ মন্দ করার জন্য দায়ী এ কারণে যে, তাকে আল্লাহ ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, সে নিজের ক্ষমতা ও ইচ্ছা শক্তি মন্দের জন্য ব্যয় করল কেন? এরপরও তাকদীর সম্পর্কে এরূপ প্রশ্নের পর প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে এবং মনে তাকদীর ও ভাগ্য সম্পর্কে নানান প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, এরূপ প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে ঘাটাঘাটি করে অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন, কেননা তাকদীরের বিষয়টি এমন এক জটিল রহস্যময় যার প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটন করা মানব মেধার পক্ষে সম্ভব নয় এবং তা উদঘাটনের চেষ্টা করাও নিষিদ্ধ । আমাদের কর্তব্য হল তাকদীরে বিশ্বাস করা, আর আল্লাহ পাক আমলের দায়িত্ব দিয়েছেন তাই আমল করে যাওয়া।
তাকদীর সম্বন্ধে ঈমান রাখার অর্থ হল নিম্নোক্ত বিষয়াবলীতে বিশ্বাস রাখা :
১. সব কিছু সৃষ্টি করার পূর্বেই আল্লাহ তাআলা সব কিছু লিখে রেখেছেন।
২. সব কিছু ঘটার পূর্বেই আল্লাহ তা'আলার অনাদি-জ্ঞান সে সম্পর্কে অবহিত এবং তার জানা ও ইচ্ছা অনুসারেই সবকিছু সংঘটিত হয় ।
৩, তিনি ভাল ও মন্দ সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তবে মন্দ সৃষ্টির জন্য তিনি দোষী নন বরং যে মাখলূক মন্দ উপার্জন করবে সে দোষী, কেননা মন্দ সৃষ্টি মন্দ নয় বরং মন্দ উপার্জন হল মন্দ । মন্দ সৃষ্টি এজন্য মন্দ নয় যে, তার মধ্যেও বহু রহস্য এবং বহু পরোক্ষ কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তাই ভাল কাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং মন্দ কাজে তিনি অসন্তুষ্ট।
৪. আল্লাহ তা'আলা কলম দ্বারা লওহে মাহফুজে (সংরক্ষিত ফলকে) তাকদীরের সবকিছু লিখে রেখেছেন। তাই লওহ, কলম ও লওহে যা কিছু লিখে রাখা হয়েছে সব কিছুতে বিশ্বাস রাখা তাকদীরে বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত।
৫. মানুষ একদিকে নিজেকে অক্ষম ভেবে নিজেকে দায়িত্বহীন মনে করবে না এই বলে যে, আমার কিছুই করার নেই তাকদীরে যা আছে তা-ই তো হবে! আবার তাকদীরকে এড়িয়ে মানুষ খোদার সৃষ্টির বাইরেও কিছু করে ফেলতে সক্ষম- এমনও মনে করবে না।
৬. মানুষের প্রতি আল্লাহর যত হুকুম ও আদেশ নিষেধ রয়েছে, তার কোনটি মানুষের সাধ্যের বাইরে নয়। কোন অসাধ্য বিষয়ে আল্লাহ কোন হুকুম ও বিধান দেননি।
৭. আল্লাহ তাআলার উপর কোন কিছু ওয়াজের নয়, তিনি কাউকে কিছু দিতে বাধ্য নন, তার উপর কারও কোন হুকুম চলেনা, যা কিছু তিনি দান করেন সব তাঁর রহমত ও মেহেরবাণী মাত্র ।
আল্লাহর ছিফাত বা গুণ প্রকাশক ৯৯টি নাম সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন
No comments